রামপুরহাট থেকে পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড় যাত্রা হান্ড্রেড সিসি বাইক নিয়ে

 বৃহস্পতিবার জানতে পারলাম যে সোমবারের ছুটি টা আমরা পাব মুখ্যমন্ত্রীর অর্ডার। জানা মাত্রই কাজ সঙ্গে সঙ্গে আমার সহযাত্রী সঙ্গী অথবা পত্নী যাই বলেন একটা ফোন লাগিয়ে দিলাম। শুনছো সোমবারে আমরা পাচ্ছি ছুটি, শুনে সে তো এক পায়ে খাড়া,  সাথে সাথে বলে তাহলে আর কেন ভাবি অতি, চলো পুরুলিয়া, আমি বললাম প্ল্যান  হোগিয়া চলো বেরিয়ে পড়া যাক।


মল্লারপুর রামপুরহাট থেকে পুরুলিয়া যেতে গেলে সিউড়ি হয়ে যাওয়াই সবথেকে ভালো কিলোমিটার এর দিক থেকে দেখতে গেলে এটাই সব থেকে কম প্রায় 230 কিলোমিটার। বেশ কিছু রাস্তা দেখার পরে আমরা সিউড়ি হয়ে ভায়া দুর্গাপুর এবং রানীগঞ্জ হয়ে পুরুলিয়া যাওয়ার রাস্তাটি পছন্দ করলাম কারণ এই রাস্তা অন্যান্য রাস্তার তুলনায় যথেষ্ট ভাল এবং খারাপ রাস্তা পাবার সম্ভাবনা রানীগঞ্জের কাছে কিছুটা হলেও সেটা অনেক কম।


সুতরাং মনে উদ্বেগ নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করার প্ল্যান করলাম ভোর বেলায় সাড়ে তিনটে, যদিও শেষ পর্যন্ত আমরা সাড়ে সাতটার সময় বাড়ি থেকে বের হতে পারলাম।

যাত্রা শুরুর আগেই কিছু লুচি তরকারি করে নিয়েছিলাম যাতে এই করোনার সময় আমাদের বাইরের থেকে কোন খাবার কিনে খেতে না হয়।

যথারীতি ভাবে সব জামা কাপড় গুছিয়ে সঙ্গে খাবার দাবার নিয়ে বেরোবার পর হঠাৎ করে যেন আমাদের খিদেটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো। অগত্যা সিউড়ি পৌঁছাবার আগেই একটি সুন্দর বন্য পরিবেশ এবং গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাতরাশ সম্পন্ন করলাম। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ তখনই নেওয়া যায় যখন পেটের জ্বালা টি সুন্দর হবে সমাপন হয়।

যাই হোক সবুজের সমাগমে নিজেদের প্রাতরাশ এবং এক কথায় ছোটখাটো বনভোজন শেষ করে নিজেদের যাত্রা শুরু করলাম। সামান্য মেঘলা আকাশ যদিও গ্রীষ্মকাল তাও রোদ্দুরের তেমন ঝলকানি আমাদের সহ্য করতে হয়নি কারণ মেঘদুত ছিল আমাদের সহায়।

প্রকৃতিকে সাথী নিয়ে বাইকের পিঠে চড়ে বনবিহার শেষ করে প্রায় 1 ঘন্টা 15 মিনিটে সিউড়ি পৌছালাম এতক্ষণ সময় লাগার কথা নয় কারণ আমরা বহুবার দাঁড়িয়েছি। সিউড়ি ছেড়ে আরও 14 কিলোমিটার যাওয়ার পর আমাদের চেনা রাস্তার বাইরে এবার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম। সাথে ফ্লাক্স এ ছিল ধূমায়িত গরম চা হঠাৎ করে রাস্তার মধ্যে চায়ের চেষ্টা মনকে ব্যাকুল করে তুল্লো। অগত্যা সেটিকে মেটাতে রাস্তার পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে পড়লাম।

ব্যাগ থেকে বেরোল চা, সাথে একটি ছোট বিস্কুটের প্যাকেট। আমার পত্নীর অনুরোধে আর জলের অভাবে কাপ একটাই বার করলাম কারণ যেটাই খাব সেটা ধুতে তো হবেই জল পাব কোথায়? যাক ধীরে ধীরে পান করলাম গরম ধূমায়িত চা। সাথে ছোট্ট ছোট্ট করে বিস্কুটের কামড় পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে রেললাইন, লকডাউন এর কারণে তা ফাঁকা সুতরাং ট্রেন দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থাকলাম মনে হয়েছিল বটে যদি একবার পথের পাঁচালীর সিনেমার মতো ধানের ক্ষেত দিয়ে ট্রেন দেখতে যাওয়া যায় কিনা কিন্তু করোনার হস্তক্ষেপে সেই মনের ইচ্ছাকে দাবিয়ে রেখে আবার গাড়িতে চড়ে এগিয়ে চললাম কাল পথের বুক চিরে।

            

যদিও যাত্রা শুরুর আগেই আমার পত্নীর সদিচ্ছায় ড্রাইভার এর সিট টি পরিবর্তন হয়েছে আমার জায়গায় বাইকটি চালাচ্ছে আমার অর্ধাঙ্গিনী। অচিরেই রাস্তার বদলে আমার চোখ এখন আশপাশের পরিবেশ এর দিকে।

রাস্তার আশেপাশে কোন কোন জায়গায় জমি চাষ করছেন কিছু চাষী আবার কিছু জায়গায় ধান বপন এর কাজ চলছে। কৃষকদের মনের আনন্দে গুনগুন করে গানের সাথে সেই কাজ এবং গ্রামের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মনোরম আবহাওয়া কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল।


আরো প্রায় 40 কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলাম দুবরাজপুর, পাণ্ডবেশ্বর হয়ে আমরা এখন রানীগঞ্জের পথে। রানীগঞ্জ যেটি পশ্চিমবঙ্গের কয়লা খনির একটি আখড়া, ইচ্ছা হল রানীগঞ্জ কয়লা খাদান দেখব।

যদিও করোনার কৃপায় এবং পুলিশের বাধা অতিক্রম করে আমরা কয়লা খাদান দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হলাম। আমার পত্নীর কয়লা খাদান থেকে 1 কেজি কয়লা নিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা অচিরেই কয়লা খনিতে আবদ্ধ থেকে গেল পরের বারের অপেক্ষায়।

রানীগঞ্জে বেশ কিছুটা পথ আমরা খারাপ পেলাম গাড়িটা প্রায় খারাপ হয় হয় এইরকম অবস্থায় বহুকষ্টে নড়তে-চড়তে সেটি টপকে এবার ভালো রাস্তা ধরে আমরা আদ্রা এর পথে। 


এরইমধ্যে রানীগঞ্জের একটি হিন্দু ধাবায় নিজেদের মধ্যাহ্নভোজন এর পর্ব টি শেষ করেছি। রাস্তার পাশে একটি হোটেল আশেপাশে গাড়ির বহর দেখে এইটুকু বুঝেছিলাম খাবারটা খুব একটা খারাপ হবে না, যাই হোক আমাদের সেই চিন্তা ভাবনাকে বিন্দুমাত্র ভুল প্রমাণিত করে নি ওই হোটেল। খাবারটা ছিল বেশ ভালো যদিও নিরামিষ এবং সাথে ছিল গরম ডিম ভাজা। একটি করে কোলড্রিংস পান করার পরে আমরা এগিয়ে চললাম। যদিও আমার পত্নী আমাকে সজাগ করেছিল যে এত কোলড্রিংস খাওয়া মোটেই ভালো নয় তবুও নিয়ে যখন নিয়েছি তখন শেষ করেই ছাড়লাম।

হেলতে দুলতে আস্তে আস্তে সময়টা যে বেশ অনেকটা পেরিয়ে গেছে তা খেয়ালই হয়নি। আমার পত্নী তো রেগে মেগে বলেই ফেলল এতবার দাঁড়ালে টাইমে পৌছাতে পারবে তো? তারি কথায় সজাগ হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় সাড়ে তিনটে। মনে একটু ভয় ধরলো শেষ রাস্তাটি কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরে ওঠার রাস্তা সুতরাং পাহাড়ি, তাই যতটা সম্ভব রাত্রে না যাওয়াটাই ভালো। ভাবা মাত্রই কাজ, গাড়ির এক্সপ্লোরেশন একটু স্পিড বাড়িয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে।

দিদির একটি ফোন এল, দিদি মনে করিয়ে দিলো, আদ্রা থেকেই জয়চন্ডী পাহাড় যাওয়ার রাস্তা শুরু হয় যদিও সময়ের অভাবে বাইকের মুখটা আমরা সেই দিকে ঘুরায় নি ওটা অন্য একবারের জন্য থাক।

আদ্রাই যখন ক্রসিং পার হচ্ছি পাশে বেশ কিছু আনারসের দোকান বেশ পাকা আনারস, আনারসের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো, তাই দুজনে একটা আনারস কাটার অর্ডার দিলাম এবং সাথে সাথেই খেয়ে সাবাড় করে ফেললাম, খুব মিষ্টি অসাধারণ। খাবার পরে আবার যাত্রা শুরু করেছি পুরুলিয়ার মুখে। আদ্রা থেকে পুরুলিয়া পৌঁছতে আমাদের বেশ কিছুটা সময় লাগলো প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পুরুলিয়ায় পৌঁছে একটু চা খেয়ে নিলাম। একটি দোকানে জিজ্ঞেস করতে, সে বললো এখনো অযোধ্যা পাহাড় প্রায় 40 কিলোমিটার হিসাব করে দেখলাম খুব কম করে হলেও দীর্ঘ দেড় ঘন্টা লাগবে। 

যাত্রা শুরু করেছি এমনই সময় গোদের ওপর বিষফোঁড়া গাড়ির পেছনের চাকা টি গেলো পাংচার হয়ে।


অগত্যা যাত্রায় বিঘ্ন ঘটার জন্য দুজনেরই মন খুব চিন্তিত, খুলে ফেললাম ডি কি তারপরে অস্ত্রশস্ত্র বার করে খুলে ফেললাম পেছনের চাকা টি। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানিয়ে রাখি পুরুলিয়া থেকে অযোধ্যার রাস্তায় গাড়ি সারাবার দোকান খুবই কম।

প্রায় 45 মিনিট ধরে দুজনের মেহনতে আর আনা যন্ত্রপাতি সহযোগে গাড়ির পেছনের চাকার ছিদ্র বন্ধ করে যাত্রা শুরু করতে করতে আরও 15 মিনিট লেগে গেল। সময় প্রায় 6:15 সুর্য ডুবুডুবু সামনে জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা থেকে থেকে কালো হয়ে যাচ্ছে। এখনো 34 কিলোমিটার পথ, আমাদের কোন ঘর বুকিং নেই, তাই বিষয়টি আরও চিন্তার। মনের জোর নিয়ে ঠিক করেই ফেললাম থাকলে উপরে থাকবো নয়তো থাকবো না। যেমনি ভাবে অমনি কাজ গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করে দিয়েছি এক্সিলারেশন এ বেশ কিছুটা স্প্রিড ধরে রেখেছি এগিয়ে চলেছি পাহাড়ের দিকে। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে কিছুটা খারাপ রাস্তায় থাকার জন্য গাড়ির স্প্রিড কম করতে হয়েছিল। আমরা এখন অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে, একবার চিন্তা করে নিলাম, আশে পাশের দোকানে একবার জিজ্ঞেস করে নিলাম, যে ওপরে ঘর পাওয়া যাবে তো? দোকানের এক ব্যক্তি আশ্বস্ত করে বলল : আরে দাদা এত চিন্তা করছেন কেন? ওপরে 50 মিটার অন্তর অন্তর ঘর পাবেন হোটেল পাবেন থাকার জায়গা পাবেন কোন চিন্তা নাই চলে যান। 


তার কথায় বেশ কিছুটা মনে জোর নিয়ে গাড়ী পাহাড়ের রাস্তায় চড়াতে শুরু করলাম। অন্ধকার সাথে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা এটা এক অন্যরকম অনুভূতি রাস্তাতে শুধু আমরা দুজন বাকি আর একটা গাড়ি অথবা কোন মানুষকে দেখতে পাচ্ছি না। ভয় লাগাতো একটা অনিবার্য বিষয় যাইহোক প্রায় আট কিলোমিটার যাওয়ার পর একটি হোটেল দেখতে পেলাম ঠিক করলাম যদি ওপরে ঘর না পাই নেবে সে এই হোটেলে থাকবো। আনন্দের বিষয় সেই হোটেল থেকে একজন ব্যক্তি বাইক নিয়ে আমাদের সাথে সাথে চলতে শুরু করলো যদিও অচেনা তবুও ভাল লাগল যে একজন তো সাথে আছে।

এইটুকু ভরসা নিয়েই ঘন অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় বাইক চালাতে চালাতে প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ পৌছালাম অযোধ্যা হিল টপ। পৌঁছে গিয়ে এইটুকু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম যে নিচের ভদ্রলোক ভুল বলেন নি, প্রায় 50 মিটার ছাড়া ছাড়া এখানে হোটেল, হোমস্টে, হলিডে হোম কোন কিছুরই অভাব নাই। অযোধ্যা হিল টপ এর কাছেই একটি হোটেলে কথা বললাম, তারা বেশ কিছুটা ভিতরে গিয়ে একটি থাকার হোটেল দেখালো রুম গুলো ভালো, তবে লকডাউন এর জন্য জনসমাগম কম তাই রুম গুলো সেই ভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। বাড়ির মালিক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে সে বলল লাস্ট এই হোটেলে প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস আগে লোক এসেছিল তার আগে প্রায় এক বছর কোন লোক আসেনি। অচিরেই অবস্থাটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না যাই হোক হোটেলের সামনের লনে বাইক গ্যারেজ করে মালপত্র নিয়ে গিয়ে হোটেলে উঠলাম। লকডাউনের কারণে ভাড়াতেও কিছুটা সাশ্রয় হলো মাত্র 800 টাকাতেই আমরা রুমটি ভাড়া করে নিলাম, জানতে পারলাম রাস্তার পাশে খাবার হোটেলটি এই ব্যক্তিই তাই খাবার সেদিনকে ওখান থেকে বুক করে নিলাম, নিচে যাবার মতো শারীরিক অবস্থা ছিল না, যাইহোক প্রায় 230 কিলোমিটার বাইকে করে আসা তাই খাবারটা ঘরেই আনিয়ে নিলাম।



পরের দিন 11 ই জুলাই রবিবার সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় সাড়ে ছটা চট করে ব্রেকফাস্ট টা সেরে নিয়েই আজকের টুর করতে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমাদের লক্ষ্য অযোধ্যা পাহাড়ের উপর সারাদিন বাইকে করে ঘোরা। সকালবেলায় বেরিয়ে প্রথমেই যা দেখলাম সেটি হল সীতাকুণ্ড;

সীতাকুণ্ড - জায়গাটার পরিবেশ খুবই সুন্দর বাইকটা একটি বটগাছের নিচে রেখে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হয়। 


বাইক রাখার পর প্রায় দুই কিলোমিটার হাটলাম, গিয়ে পড়লাম একটু ছোট ঝরনা এবং পাহাড়ি সমতল ভূমির উপরে সবুজে ঘেরা পুরনো কিছু গাছ ঠিক সেখান থেকে 12 মিনিটের নিচের দিকে নেমে গেছে, যেখানে গেলেই সীতাকুণ্ড।

 

বিষয়টা সত্যিই একটু আশ্চর্য এর কারণ পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঘোলা পাহাড়ি ঝর্ণার জল ঠিক তার পাশেই মাটির নিচে থাকে অনবরত স্বচ্ছ পরিষ্কার জল এর একটি কুয়া এর মতো দেখতে অংশে অনবরত জল বেরিয়ে চলেছে। শুধু ওইটুকু পরিমান জল এতটাই স্বচ্ছ পান করার জন্য উপযুক্ত কিন্তু তার চারিপাশে যে জল বয়ে যাচ্ছে তার প্রচন্ড ঘোলা এবং নোংরা।


প্রাকৃতিক এক অপূর্ব সৃষ্টি কে দেখার পর আমরা এগিয়ে চললাম পরবর্তী আকর্ষণ মার্বেল ড্যাম । এখান থেকে প্রায় 5 কিলোমিটার পাহাড়ে যাওয়ার পর ত্রিমুখী মোড় পেলাম। এই ত্রিমুখী মোড় থেকে ডান দিক দিয়ে রাস্তাটি ধরে আরো ছয় কিলোমিটার গেলাম এবার আমরা পৌছে গেলাম মার্বেল ড্যাম। 


মার্বেল ড্যাম- খুব এক কথায় বলতে গেলে এটি আসলে একটি মার্বেল পাথরের বা শ্বেতপাথরের খাদান যেটি বেশ কিছুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য খাদানে যেটি ঘটে, এখানেও ঠিক তাই ঘটেছে, খাদান বন্ধ হবার পরে সেখানে জলের সমাগম হয় এবং সেই ছোট্ট জল সরবরাহ ধীরে ধীরে একটি বড় দিঘিতে রূপান্তরিত হয়। যাকে আমরা ড্যাম বলি। এই ড্যাম এর চারিপাশের পরিবেশ খুবই সুন্দর মার্বেল পাথরের সাদা খুব উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এই ড্যাম। এর উচ্চতা প্রায় 30 থেকে 40 মিটার যদিও তা সঠিকভাবে জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
 এর একপাশে পাহাড়ের সবুজ গাছের সমারোহ আর ঠিক অন্যপাশে একটি উঁচু দেয়াল ছবি তোলার জন্য এবং বেশ কিছুক্ষন সময় একান্তে কাটাবার জন্য এটি একটি অতুলনীয় জায়গা। এর একদিক দিয়ে ড্যাম ই নেমে যাবার রাস্তা ইচ্ছা করলে এখানে স্নান করা যেতে পারে। কিন্তু জানা ছিলোনা বলে আমরা তো আর কোনো সরঞ্জাম নিয়ে যায়নি তাই আমাদের সেই মনস্কামনা অপূর্ণই থেকে গেল।

এর আশেপাশের রাস্তা থেকে এবং বেশ কিছুটা উপরে উঠে আরো কিছু ভালো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃশ্য আমরা দেখতে পেলাম ভাগ্যক্রমে সেদিনে আকাশ ছিল একদম পরিষ্কার এবং নীল যে কারণে এখানকার ছবিগুলো ছিল অসাধারণ প্রায় ঘন্টা দুয়েক আমরা এখানে সময় কাটালাম এবং ছবি তুললাম।

এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সোনায় সোহাগা মতো হাতে ছিল এক পেয়ালা গরম ধূমায়িত চা যেটি আমরা ফ্লাক্সে করে সকালবেলা নিয়ে বেরিয়েছিলাম।


সকালের টি ব্রেক শেষ করে আমরা এবার ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম লক্ষ্য বামনী ফলস। ওই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে আমরা পৌঁছালাম বামনী ফলস দুর্ভাগ্যক্রমে লকডাউন এর কারণে এটি ছিল বন্ধ অগত্যা আমাদের মনের পিপাসা কে সেখানে আবদ্ধ করে রেখে পাহাড়ের রাস্তা ধরে আমরা ফিরতে শুরু করলাম।

রাস্তার পাশে বিভিন্ন জায়গায় পাথরের গায়ে সুন্দর প্রজাপতি ও পতঙ্গের ছবি আঁকা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে একটি অপরূপ সৌন্দর্য বিকাশ করছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কিছু ছবিও তুলেছি সত্যি পাথরের গায়ে কারুকার্য দেখার মত। এর পরবর্তীতে আমরা ফিরে এলাম সেই তিন মাথার মোড়ে সেখান থেকে অপরদিকে রাস্তা ধরে মালভূমির মত পাহাড়ি গ্রাম্য পরিবেশ এবং পাহাড়ের উপরে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে প্রায় সাত আঠ কিলোমিটার যাবার পরে আমরা পৌঁছালাম আপার ড্যাম।


আপার ড্যাম- এটি অযোধ্যা পাহাড়ের একটি অন্যতম বিশিষ্ট পর্যটন আকর্ষণ পাহাড়ের মাঝে অথৈ জলরাশি যতদূর নজর যায় ততদূর শুধু জল, তার ওপরে পাশের পাহাড় গুলির ছবি ও আকাশের ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে যেটি দেখার অনুভূতি সত্যিই অতুলনীয়।

এই আপার ড্যাম এর জল বার করার পদ্ধতি টা খুব সুন্দর কারণ এটি মানব নির্মিত একটি খুবই সুন্দর পর্যটন আকর্ষণ তাই এর নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং জলের চাপ কে সঠিকভাবে ধরে রাখার জন্য জল নিকাশি ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। 


এই ড্যাম এর পাড় ধরে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এই রাস্তার একদিকে জলরাশি আর অন্যদিকে গভীর খাদ যেটি দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার জন্য এটি খুবই সুন্দর। আমরা বেশ কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটালাম এবং অনেক ছবি তুললাম এরপরে ড্যাম এর ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম অযোধ্যা পাহাড়ের দ্বিতীয় আকর্ষণ লোয়ার ড্যাম।

লোয়ার ড্যাম- উপরের ঐ আপার ড্যাম এর থেকে বেরিয়ে আসা জল দিয়ে এর নিচে আরো একটি সুন্দর ড্যাম তৈরি করা, যেটি কে সবাই লোয়ার ড্যাম বলে। যদি এটা পাহাড়ি রাস্তার প্রায় শেষের দিকে এক কথায় বলা যেতে পারে সমতল ভূমির কাছাকাছি, কিন্তু তাও এটি দেখার জন্য একটি খুবই সুন্দর জায়গা  আপার ড্যাম থেকে প্রায় 5 কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে আমরা লোয়ার ড্যাম এ পৌছালাম। লোয়ার ড্যাম এ বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা পাহাড়ের আরো নিচের দিকে যেতে শুরু করলাম এবার আমাদের পৌঁছতে হবে পাখি পাহাড়। এই পাহাড়টি ছেড়ে এখন আমাদের অন্য আরেকটি পাহাড়ে চড়তে হবে তাই রাস্তাটা কিছুটা সমতল ভূমির উপর দিয়েই যায়। প্রায় আরো 12 কিলোমিটার রাস্তা।

এটি একটি পাহাড় ঘন অরণ্য ঢাকা আর এতে জমায়েত হয় হাজার হাজার পারিযায়ী পাখি। শীতকালে এই পাখি পাহাড় একটি দেখার মত পর্যটন কেন্দ্র। যদিও বছরের যেকোনো সময়ে এখানে আসা যেতে পারে কারণ পরিযায়ী পাখির সাথে সাথে এই পাহাড়ে বাসা বেধেছে আরো অনেক রংবেরঙের পাখি। জনবসতির কলরব থেকে মুক্ত হয়ে এই পাখির কুজনে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেওয়ার যে আনন্দ তার অনুভূতি সত্যিই অনস্বীকার্য।

এখন সময়টা বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে যখন পাহাড়ের নিচে পৌছালাম তখন আরো বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। এমতাবস্থায় আমাদের বেশ কিছুটা খারাপ এবং পাথরের রাস্তার সম্মুখীন হতে হলো যার দৌলতে আমাদের পিছনের চাকা টি আরো একবার ফুটো হয়ে গেল। অবস্থা খুবই শোচনীয় পাথরের মসৃণ আদায় লেগে পেছনের চাকার টিউবটি কিছুটা ছিড়ে গেছে। সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের সাথে আরও একটি নতুন কিউব আছে কিন্তু বাকি রাস্তাটাও খুব খারাপ। চাকা সারিয়ে উঠতে উঠতে বিকেল গড়িয়ে সূর্য তখন প্রায় পশ্চিমে ঘুমাতে যায়। পাশের একটি চায়ের দোকানে দুইজনে দুই পেয়ালা চা খেলাম কারণ সারাদিন বাইক করার পরে এইভাবে চাকা সরানোর পর শরীরটা ছিল খুবই ক্লান্ত।

সেই চায়ের দোকানদার আমাদের দুজনকে দেখে এবং তারসাথে সময়ের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে সচেতন করল যে এরপরে এখানে প্রচন্ড হাতির উপদ্রব হয়। যদি এরপরে আমরা ওই রাস্তায় যাই এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যদি হাতির মুখোমুখি হই তাহলে ফিরে আসার কোন সুযোগ হয়তো আমরা পাবোনা।

তিনি আমাদের সচেতন করার জন্য আরও জানালেন যে মাত্র দুই তিন দিন আগে এখানে নাকি হাতির উপদ্রবত্র আহত হয়েছেন চার পাঁচ জন পর্যটক। যদিও তাদের কাছে চারচাকা গাড়ি ছিল তা সত্ত্বেও তারা এতটাই আহত হয়েছিল যে তাদেরকে সামনের হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিল।

যেটা শোনার পর আমাদের বেশ কিছুটা ভয় লাগলো তাই দূর থেকেই পাখি পাহাড় কে দেখে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখনো আমাদের যেতে হবে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা যেটি সম্পূর্ণ পাহাড়ি এবং অন্ধকারে চালানোর অযোগ্য। কারণ আগেই আমরা দেখেছি এই রাস্তা ঠিক কতটা খারাপ।

যাই হোক মনের ইচ্ছাকে আর বেশি প্রবল না করে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বাইক ঘুরিয়ে ফিরতে শুরু করলাম সৌভাগ্যক্রমে ফেরার সময় আমাদের কোন বিভ্রান্তির সম্মুখীন হতে হয় নি। যখন আমরা হোটেলে পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি হয়েছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম কারণ সময়টা রাত ন'টা। ঘোরার আনন্দে ভুলে গিয়েছিলাম।

আমাদের আবার কালকে সকালে ফিরতে হবে ঘনবসতির সেই কলরবে এবং এই যাত্রা শুরু করতে হবে পরের দিন ভোর বেলায়।

থাকার হোটেলে ফেরার আগেই আমরা খাবার হোটেলে ভালো করে ভাত তরকারি ডিম ভাজা খেয়ে নিলাম কারণ খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম শোবার পরে আর কেউ আমাদের ঢাক ঢোল পেটালেও ঘুম ভাঙাতে পারবে না। শরীরটা ছিল প্রচন্ড ক্লান্ত কিন্তু মনটা তখনো পাখিদের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছে অযোধ্যার পাহাড়ি রাস্তার আনাচে কানাচে। কাল 12 তারিখ মানে 12 ই জুলাই আমাদের ফেরার দিন ।

সোমবার সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে পারিনি আমাদের বেরুতে প্রায় আটটা বেজে গিয়েছিলো কিন্তু বাড়িওলার কথামতো আমরা কিছুটা দেরি করি বেরহই কারণ পাহাড়ি রাস্তায় নামার সময় আরো একটি সুন্দর জায়গা আমাদের অপেক্ষায় ছিল নাম হচ্ছে বাকা ডহর না এটা ঠিক আমাদের দিদির সিধু কানু ডহর এর মত নয় এই ডহরের মানে সত্যিই রাস্তা।

বাকা ডহর - এই বাকা ডহর পৌঁছাতে আমাদের প্রায় সাড়ে নটা হয়ে গেল। উপর থেকে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে সাথে সূর্যের আলো এখানে পড়ে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। 

আমার পত্নীর আবার মনের ইচ্ছা জাগল যে সেখানে নিজে ড্রাইভ করেন নামবে। মনে কিছুটা ভয় লাগলে ও তার হাতেই সঁপে দিলাম। ইঞ্জিন শুরু করার কোন দরকার হয়নি কারণ নিম্নমুখী রাস্তায় শুধু ব্রিকের সাহায্যেই খুব সুন্দর ভাবে গড়াতে গড়াতে পার হয়ে গেলাম এই বাকা ডহর।


 এর পরেও আমরা বাকি রাস্তাটুকু আসতে আসতেই পার হলাম, আশপাশের সুন্দর পাহাড়ি পরিবেশকে দেখতে দেখতে, কারণ ওঠার দিন এই রাস্তাটি পুরোটাই আমরা অন্ধকারে বাইক চালিয়েছিলাম তাই রাত্রের সেই অসাধারণ বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা ছাড়া এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দটা উপভোগ করতে পারিনি যেটি আজ আমাদের পূর্ণ হয়ে গেল।

আর মাত্র 10 কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা এরপরে আমরা সমতল ভূমিতে নেবে যাবো, যেখান থেকে বাকি রাস্তাটুকু পার হবো, তিন দিনের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে করতে, মনের ইচ্ছা থেকেই যায় আবার হয়তো কোনদিন সুযোগ হবে এরকম সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেবার।




সুপ্রিয় শেঠ

৯০৮৮২৬৯৫২৯


Comments