শুধু মাত্র একটি দিন । আসুন গড় জঙ্গলে কাটিয়ে দিন। (গড় জঙ্গল)


গড় জঙ্গল

গড় জঙ্গল বর্ধমান জেলার একটি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। একদিনের কোলাহল এবং ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মনের পিপাসা মেটাতে চলে যেতেই পারেন, পাখির কুজন এবং অজস্র বৃক্ষের কোলে গড় জঙ্গল। বর্ধমানের এটি একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈষম্য এর দিক থেকে এই জায়গাটির মহিমা অপরিসীম। তবে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় এই জায়গার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং বাংলার ইতিহাসের একটি লুপ্ত দিক অনেক মানুষকে আকৃষ্ট করে। সরকারি সাহায্য ছাড়াই কিছু মানুষের ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকেই এই জায়গাটির একটি ইতিহাস আমাদের কাছে আজ খোলা আছে। ধীরে ধীরে সেই বিষয়গুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। যদিও এটা সম্পূর্ণ সত্যতা একটু বিচার্য বিষয়। তবে লোকমুখে শুনে যে ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাও কিছু কম আশ্চর্যের নয়।


ঐতিহাসিক গুরুত্ব:


আদি শ্রী শ্রী গড় চন্ডী মহামায়া ধাম

কথিত আছে সত্যযুগে সুপুর এর রাজা সুরথ কে তার মন্ত্রী পার্শ্বদেরা ষড়যন্ত্র করে রাজ্যচূত করে, সুপুর (বর্তমান বোলপুর) এর 3 যোজন দূরে অর্থাৎ 36 কিলোমিটার দূরে তার সাথী সমাধি বৈশ্য কে সাথে নিয়ে মেধস মুনির আশ্রম এ উপস্থিত হন এবং কৃষ্ণ নদীর (বর্তমান অজয় নদী) শাল গাছের নিচে তারা  দীক্ষা গ্রহণ করেন। এবং মেধস মুনি তাকে চন্ডী পূজা করার পরামর্শ দেন।

পরবর্তীকালে রাজা সুরথ তার রাজ্য এবং সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন এবং এই জঙ্গলেই ত্রিস্তরীয় বেদীর উপর সিংহবাহিনী মৃন্ময়ী প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানে যা দেবী দুর্গা নামে পূজিত অর্থাৎ এইখানেই সর্বপ্রথম দুর্গা প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয় । 





ইছাই ঘোষের দেউল


আদি শ্রী শ্রী গড় চন্ডী মহামায়া ধাম এর খুব সামনে আরো একটি দর্শনীয় স্থান আছে সেটি হল ইচ্ছা ঘোষের মন্দির মধ্য অষ্টাদশ শতকে নির্মিত বিগ্রহ বিহীন এই মন্দিরটি সত্যিই এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কে আরও কিছুটা ঐতিহাসিক ছোঁয়া দিয়ে যায়। পরম্পরা অনুসারীদের মতে ইছাই ঘোষের মন্দির বলেই বিবেচিত। অনুমান করা হয় যে তিনি দেবী ভগবতীর আরাধনার জন্যই এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

এই জায়গাটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে 1958 ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক আইন দ্বারা সংরক্ষিত জায়গা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

পোড়ামাটি বা টেরাকোটার কাজের ক্ষেত্রে পোড়ামাটির আকৃতি গুলি কে আগে তৈরি করে তারপরে মন্দিরের গায়ে খোদাই করা হত । কিন্তু এই মন্দিরের গুরুত্ব এখানেই যে এটি ইট দিয়ে নির্মাণ করার পর  ইটের উপর কারুকার্য করা হয় সত্যিই তা নিদর্শন তার মনকে আশ্চর্য ভরিয়ে দেয় ।


স্যাম রুপা মন্দির

কথিত আছে একসময় এই মন্দিরে নরবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল এবং এই দেবীর রং ছিল রুপালি। পরবর্তীকালে দেবীর রং পরিবর্তন হয় শ্যামা বর্ণ হয় এবং তখন থেকেই নরবলি বন্ধ করা হয়।

এই মন্দিরে বিবাহ দেবার জন্য অনেক লোক আসেন কারণ কথিত আছে এখানে বিবাহ হলে তা কখনো বিচ্ছেদ হয় না ।

তবে তো প্রেম করলে গান্ধর্ব মতে এখানেই বিয়ে করা উচিত আশপাশের জায়গায় তেমন কোনো লোক নেই আর বিবাহবিচ্ছেদের কোন চান্স নেই ।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যান্য ঘোরার জায়গা :

দেউল পার্ক 




এর সংলগ্ন দেউল পার্ক নামে একটি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ দ্বারা নির্মিত পর্যটন কেন্দ্র আছে। এখানে বড় একটি দীঘি আছে, বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে, থাকার জায়গা আছে, চারিদিক ঘেরা অপরূপ ফুলের সমারোহ আছে, আছে খোলা মাঠ,হরিণ, ময়ূর সত্যিই অজানা মনকে আনন্দ দেবার জন্য যথেষ্ট।

কিছু দূরে অজয় নদীর চর যেখানে বনভোজনের জন্য প্রতিবছর শীতের সময় মানুষ ছুটে আসে। এর সাথে আছে মেঠো রাস্তা দুপাশের ঘন জঙ্গল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অজস্র পাখি এক অজানা বন্য প্রকৃতি যা শহরের ব্যস্ত জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পাবার এক অপূর্ব ঠিকানা।


পৌঁছানো যায় কিভাবে:

বোলপুর থেকে গড় জঙ্গল যাবার রাস্তা



বোলপুর থেকে ইলামবাজার হয়ে গড় জঙ্গল প্রায় 37 কিলোমিটার রাস্তা। বাইক নিয়ে শুধু বোলপুর শহরটাকে পেরিয়ে গেলেই শুরু হয় রাস্তার দু'পাশের ঘন জঙ্গল জেটি দুর্গাপুর রেঞ্জ ফরেস্ট এর অন্তর্ভুক্ত। বোলপুর থেকে ইলামবাজার 18 কিলোমিটার রাস্তা মোটামুটি 30 মিনিট লাগে। সকালবেলার ব্রেকফাস্ট টি এখানেই সেরে নিন। সাথে সামান্য স্ন্যাকস বিস্কুট নিয়ে নিন ইলামবাজার থেকে কারণ এরপরে গড় জঙ্গল মেঠোরাস্তায় প্রবেশ করলে দোকানপাট এর পরিমাণ বেশ কম।

ইলামবাজার থেকে আট কিলোমিটার পর ডানদিকে বনকাটি রোড ধরে গড় জঙ্গল যাবার রাস্তা । এই রাস্তায় পেট্রোল পাম্প নেই এবং তেমন কোন খাবার দোকান ও নেই তাই প্রয়োজনীয় সামগ্রী এর আগেই সংগ্রহ করে নেওয়া উচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে এই রাস্তা যাত্রা একটি অপরূপ অনুভূতি বয়ে আনে।

সুতরাং খাবার কিছু স্ন্যাক্স এবং ফল বা কেক পাউরুটি সংগ্রহ করে নিন। কারণ জঙ্গলের ভিতরে কিছু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি নিতে নিতে সামান্য কিছু টিফিন করলে বেশ মজা পাওয়া যাবে।

এইখানে প্রায় 9 কিলোমিটার পাকা রাস্তার পরে মাটির রাস্তা শুরু হয় এবং এরপর বাকি যাত্রা মাটির রাস্তা ধরেই সম্পূর্ণ করতে হবে। বাইক নিয়ে যেতে গেলে এই মাটির রাস্তা খুব সাবধানে গাড়ি চালানো উচিত কারণ ধুলোর মধ্যে প্রচন্ড পরিমাণে চাকা স্কির্ট করে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক। আমি এই রাস্তায় একবার প্রায় পড়তে পড়তে বেঁচেছি। দেউল পার্ক এর সামনে সামান্য জল বা চায়ের দোকান পাবেন তাই সাথে জল বা কোলড্রিংস বোতল থাকলে তৃষ্ণা থেকে বাঁচতে পারবেন।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

জিপিএস নেভিগেশন মাটির রাস্তার আগে পর্যন্ত ভালো ভাবে পাবেন কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর ভালো ইন্টারনেট এবং লোকেশন নেভিগেশন পাবেন না। সচেতনভাবে রাস্তাটি বারবার জিজ্ঞাসা করে নিন। যদিও জঙ্গলের মধ্যে রাস্তার ডিনমিনেশন আছি।

দুর্গাপুর সিটি থেকে দেউল বা গড় জঙ্গল যাবার রাস্তা





দুর্গাপুর থেকে গড় জঙ্গল জবা দূরত্ব মাত্র 23 কিলোমিটার সময় লাগবে 45 মিনিটের মত। দুর্গাপুর থেকে রুপগঞ্জ হয়ে মালঞ্চ ডিহি কে পাশে রেখে নয় কিলোমিটার পর জঙ্গলের রাস্তা পরে। এখান থেকে 6 কিলোমিটার গেলেই গড় জঙ্গল। তবে জঙ্গলের রাস্তাটিতে নেভিগেশন সম্ভব নয় কারণ মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না সে ক্ষেত্রে আশপাশের লোক কে জিজ্ঞাসা করে নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়।

দুর্গাপুর থেকে যাওয়ার সময় ইলামবাজার না গিয়েই গড় জঙ্গলের রাস্তা আগেই চলে আসে তাই নেভিগেশন টা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য রাখবেন।

বাইকে এই ট্রিপ করার কিছু সতর্কতাঃ :

১. সাথে পানীয় জলের বোতল রাখা বাধ্যতামূলক।

২. দু লিটারের অন্তত একটি তেলের ব্যারেল জঙ্গল ট্রিপের জন্য।

৩. বাইকের জন্য যৎসামান্য টুলকিট।

৪. ধুলোতে এলার্জি থাকলে নিশ্চয়ই একটি মুখের মাক্স কভার মাক্স হলে বেশি ভালো হয়।

৫. প্রয়োজন একটি পাতলা জ্যাকেট মাটির রাস্তায় চলার সময় বা বাইক চালানোর সময় পরে নিলে ধুলো থেকে বাঁচা সম্ভব।

৬. খুচরা টাকার বন্দোবস্ত রাখা প্রয়োজন টুকটাক খরচ জন্য।

৭.মাটির রাস্তায় আস্তে চালানোই বাঞ্ছনীয় কারণ বাইকের চাকা স্কির্ট করতে।

৮. জঙ্গলের ভেতরে টাওয়ারের প্রবলেম হয় তাই নেভিগেশন খুব সতর্কতার সাথে করা উচিত।


প্রয়োজনীয় খাদ্য বস্তু :

১. দু তিন প্যাকেট ছোট 5 টাকায় বিস্কুটের প্যাকেট।

২. জলের বোতল ও সম্ভব হলে কোলড্রিংস এর বোতল।

৩. চিপস বা কেক জাতীয় মুখরোচক দ্রব্য জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে বেশি আনন্দ দেবে।

৪. দুপুরের খাবার ইলামবাজারে কমপ্লিট করতে হবে এরপরে ভাত খাবার তেমন কোনো হোটেল নেই।

৫. যদি দেউল পার্কে হোটেল বুক করে থাকে তাহলে এখানে খাবার ব্যবস্থা আছে দুপুরের খাবার এবং চিপস স্নাক্স ও এখানে পাওয়া যায়।

৬. শ্যামা রুপা মন্দিরে আগে থেকে বলে দিলে প্রসাদের বন্দোবস্ত এনারা করে দেন, সেটির একটা অপূর্ব অনুভূতি আছে চাইলে উপভোগ করতে পারেন।


Comments